ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ পৌষ ১৪৩১

গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে নির্মম-নিষ্ঠুর শাসনে বাংলাদেশের সবকিছুই ভেঙে পড়েছিল। অত্যন্ত পরিকল্পিত লুটপাট ও অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে শেষ মূহূর্তে দেশের নিয়ন্ত্রণ দিল্লির হাতে সোর্পদ করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য। আজীবন ক্ষমতায় থাকার বাসনা চরিতার্থ করতে গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের সবগুলো অঙ্গের উপর ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিরোধীদের শিরদাঁড়ায় ভয় ধরিয়ে দিতে গুম-খুন-গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। উপমহাদেশের কয়েকশ বছরের ইতিহাসে আর কোনো শাসককে নিজ দেশের মানুষ, প্রকৃতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর এমন নির্মম ধ্বংসাত্মক ভ’মিকায় দেখা যায়নি। মহাযুদ্ধে পরাজিত হিটলার-মূসোলিনীও নিজ দেশের নাগরিকদের উপর এমন পৈশাচিক আচরণ করেননি। হাসিনার স্বৈরশাসন চিরস্থায়ী করার ভারতীয় চক্রান্তের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অফিসাররা। এই সেনাবাহিনী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর শেকড় আরো পেছনে। স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক-কমান্ডার (বীরোত্তম) জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসম সাহসী ভ’মিকার কারণে পাকিস্তান সরকারের (হিলাল ই জুরাত) খেতাবে ভ’ষিত হন। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে ভারতের স্বপ্নভঙ্গের অন্যতম শক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সেনা সদস্যরা। জিয়াউর রহমানের মত আরো অনেক অকুতোভয় যোদ্ধা ভারত ও ইসরাইলীদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিমান যোদ্ধা সাইফুল আজমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধে বহুজাতিক বিমান বাহিনীর হয়ে একের পর এক ইসরাইলী বিমান ধ্বংসের অসামন্য কৃতিত্ব সাইফূল আজমকে এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারি করেছিল। জিয়াউর রহমান এবং সাইফুল আজমদের বীরত্ব গাঁথা ও কৃতিত্ব বুকে ধারণ করে তাদেরই হাতে গড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শত্রুমিত্র চিনতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে কখনো ভুল করে নি, পিছ পা হয়নি। ২০০১ সালে রৌমারি ও বড়াইগ্রাম সীমান্তে রাতের অন্ধকারে অন্তত ১০ প্লাটুন সশস্ত্র বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশে ঢুকে আকষ্মিক এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী করলে একটি সীমান্ত চৌকিতে দায়িত্বরত মাত্র ৮জন বিডিআর জওয়ান জীবন বাজি রেখে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তাদের রুখে দিতে সক্ষম হয়। সেই যুদ্ধে শতাধিক সেনা হারিয়ে ভারতীয় হানাদাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিডিআর প্রধান আ ল ম ফজলুর রহমান দেশপ্রেম ও সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। যোগ্য কমান্ডারের নির্দেশে মাত্র ৮জন বিডিআর জওয়ান শত শত সশস্ত্র ভারতীয় হানাদারকে রুখে দিয়ে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তবে প্রভুদেশের সীমান্ত রক্ষীদের এভাবে মেরে লাশ ফেলে দেয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনা যারপরনাই নাখোশ হয়েছিলেন। তিনি সাহসী যোদ্ধাদের পুরষ্কৃত করার বদলে তিরষ্কৃত করেছিলেন এবং নিজে ভারত সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে দু:খ প্রকাশ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তখনই বিডিআর এবং বাংলাদেশ আর্মির উপর প্রতিশোধ ও উপযুক্ত জবাব দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল চাণক্যবাদী ভারতীয়রা। ২০০৯ সালে ভারতের সহায়তায় শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দেড় মাসের মাথায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে পৈশাচিক গণহত্যা সংঘটনের মধ্য দিয়ে ভারত এবং শেখ হাসিনা এক ঢিলে তিন পাখি মেরেছিল।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে রুদ্ধ করে ভিন্ন মতে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের হেনস্তা করা হয়েছিল। তুচ্ছ ব্যক্তিগত মন্তব্যের কারণে প্রবীণ কলামিষ্ট-বুদ্ধিজীবী ব্যারিস্টার মুঈনুল হোসেনকে ধরে জেলে ভরার দৃশ্য, কিংবা ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলম, কার্টুনিষ্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। একই মামলায় গ্রেফতার করে সাংবাদিক মুশতাক আহমেদের জামিন নাকচ ও নির্যাতন করে কারাগারেই হত্যা করা হয়েছিল। বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, প্রবীন সাংবাদিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে অফিস থেকে গ্রেফতার করে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এমনই দু:সহ অবস্থায়ও খুব অল্প সংখ্যক সাহসী সাংবাদিক, কলমযোদ্ধা সব হুমকি-ভয় তুচ্ছ করে আপসহীনভাবে সত্য উচ্চারণ করেছেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হয়েছে, জামিন চাইতে গিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত হতে হয়েছে। আমার দেশ, দিনকাল পত্রিকা ও দিগন্ত, ইসলামি টিভি বন্ধ করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং শত শত মানুষের রুটি-রুজির পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এতকিছুর পরও প্রবীন লেখক, বুদ্ধিজীবী বদরউদ্দিন উমর, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির চরম প্রতিক’ল সময়ে সত্য উচ্চারণ করেছেন। নুরুল কবিরের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘ভারত আমাদের শত্রু, এটা বুঝতে পারাই অনেক বড় অর্জন।’ অবশ্য আরো বহু আগে, মাওলানা ভাসানি আরো জোরালোভাবে বলেছিলেন, ‘ভারত আমাদের শত্রু, এটা যে প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তারাই সৌভাগ্যবান’। রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা বলে কিছু নেই, তেমনি রাষ্ট্রনীতিতেও চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু থাকতে পারেনা। পারস্পরিক লেনদেন, বোঝাপড়া, মিথস্ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা নির্ধারিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে কিংবা পরে কখনোই ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত কখনোই বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না। একাত্তরের স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের মুখোশ পরে চরম শত্রুতা ছিল আওয়ামী-বাকশালি শাসনের অধীনতামূলক মিত্রতার ভাঁড়ামি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের এই জেন-জি প্রজন্মই প্রথম বুঝতে সক্ষম হয়েছে, ভারত আমাদের শত্রু এবং রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাদের বশংবদ শাসক শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে তার সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা পতিত স্বৈরাচারোর দোসররা তাকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তা নাহলে দিল্লীতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের উস্কানি দেয়ার সুযোগ থাকতো না। মূলত: ১৯৭৫ সালের ক্যু’য়ে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনা-রেহানাকে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ভারতের পুতুল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রশিক্ষিত ও লক্ষ্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছিল। এক সময়ের তুখোড় গোয়েন্দা অফিসার অজিত দোভাল ৫ দশক ধরেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে দিল্লীর গাজিয়াবাদ সেনানিবাসে সেই অজিত দোভালই নাকি বরণ করেছেন। দিল্লীতে বসে শেখ হাসিনা এখন যা কিছু করছেন সম্ভবত তার সবই অজিৎ দোভালের পরামর্শেই করছেন। কথিত মোবাইল কল রেকর্ড ফাঁস, নেতাকর্মীদের উস্কানিমূলক নির্দেশনাসহ সবকিছুই হচ্ছে ভারতীয় পরিকল্পনার আওতায়।

অনেক হুমকি-ধামকি, পাল্টা হুমকি ও আক্রমণাত্মক বাগাড়ম্বরের মধ্যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের পারদ যখন উত্তেজনায় তপ্ত, তখনই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে কিছু ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি দিল্লিতে গিয়ে সংসদীয় কমিটিকে তিনি যে ব্রিফ করেছিলেন, তা ছিল সম্পর্কোন্নয়নে ইতিবাচক। তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনা যা বলছেন বা করছেন তা দিল্লি সমর্থন করেনা। কিন্তু পররাষ্ট্র সচিবের ব্রিফিংয়ের সাথে সামগ্রিক কর্মকান্ডের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ভারত যে সব অনৈতিক সুযো- সুবিধা ভোগ করছিল, অর্ন্তবর্তী সরকারের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে তারা তা অব্যাহত রাখতে চাইছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে তারা সহজভাবে মেনে নিতে নারাজ। ষোল ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে দেয়া এক এক্স-বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে ৯ মাসের প্রতিরোধযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযানকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করে যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এক সপ্তাহে মিত্র বাহিনী হিসেবে ভারতীয় ইষ্টার্ন কমান্ডের অংশগ্রহণকেই পুরো কৃতিত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ভারতের বিজয় বলে দাবি করেছেন। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য কৃতিত্বের কথা তিনি উল্লেখও করেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মতলববাজি এ দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আগেই আঁচ করতে পেরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘হাজার সাল কা বদলা লিয়া’ । এটা কিসের ইঙ্গিত ছিল? সাচল্লিশের দেশভাগের ২৩ বছরের মাথায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বললেন হাজার বছরের বদলা নেয়ার কথা! মূলত: তাদের অন্তরে সব সময় ছিল হিন্দু-মুসলমানের ভেদ-বুদ্ধি। মুসলমানদের দিল্লী ও বাংলা বিজয় এবং হাজার বছর শাসনের পর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে হিন্দুত্ববাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথাই তিনি বুঝিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগণ একটি অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে একটি বৈষম্যহীন আধুনিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নবযাত্রার সূচনা করতে চায়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব, চীন-জাপানসহ উন্নয়ন অংশীদাররা বাংলাদেশের এই নবযাত্রায় অর্ন্তবর্তী সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ভারত পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এবং সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে সবকিছু ব্যর্থ করে দেয়ার বহুমাত্রিক অপচেষ্টায় ইন্ধন দিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ায় মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করার পাশাপাশি বিজেপি নেতাদের দিয়ে হুমকি ও উস্কানিমূলক বক্তব্য জারি রাখা হয়েছে। তবে নতুন বাংলাদেশের জনগণ এবং অর্ন্তবর্তী সরকার ভারতের আধিপত্যবাদকে মেনে নিচ্ছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে চাপে রেখে স্বার্থ হাসিলের ভারতীয় এজেন্ডা কোনো কাজে আসবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর বিগত ৫ দশকের আধিপত্যবাদী এজেন্ডা থেকে বেরিয়ে এসে ভারসাম্যপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কে উন্নীত করতে হলে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির বরাতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, নিজেদের স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাবে না ভারত। বাংলাদেশও নিজ স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কখনোই ভারতের জন্য হুমকি ছিল না। লাখো শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবমাননা করে শেখ হাসিনার মত নিপীড়ক গণহত্যাকারীকে সাথে নিয়ে আবারো বাংলাদেশকে নিজেদের ক্রীড়নক বানানোর খায়েশ এদেশের জনগণ আর কখনো সফল হতে দেবে না।

দেশটাকে তছনছ করে, গণহত্যা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা তার নিয়োজিত পুলিশ প্রধানকে নাকি বলেছিলেন, আমি চলে যাওয়ার পর তোমরা এমন অবস্থা করবে যেন এ দেশ আর উঠে দাঁড়াতে না পারে। গত ১৬ বছরে পুলিশ বাহিনীকে পুলিশ লীগে পরিনত করা হয়েছিল। নির্মমতা-নিৃশংসতায় পরীক্ষিত ছাত্রলীগ কর্মী, গোপালগঞ্জের আওয়ামী সিলসিলা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছিল পেটোয়া বাহিনী। তারা হাসিনার মনোবাঞ্ছা অনুসারে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রায় ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পুলিশ বাহিনী তার সক্ষমতা ও আস্থার জায়গায় পৌছতে পারেনি। অপরাধের সাথে জড়িত হাজার হাজার পুলিশ সদস্য পুরো আগস্ট মাসেও বাহিনীতে যোগ দেয়নি। সরকারের তরফ থেকে বার বার নোটিশ দেয়ার পরও কিছু সংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ শতাধিক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেয়নি। একমাসের বেশি সময় ধরে অনুপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্যরা অবশেষে কাজে যোগ দিলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাদের বর্তমান ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। একটা দেশের পুলিশ বাহিনী, এলিট ফোর্সের চরম নিস্ক্রিয়তা ও অসহযোগিতার মধ্যেও ছাত্র-জনতার ঐক্য ও সহযোগিতায় অর্ন্তবর্তী সরকার সবকিছু সামলে নিতে সক্ষম হয়েছে। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা প্রায় দেড়মাস ধরে সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছে। এরই মধ্যে সংখ্যালঘুদের সমাবেশ ঘটিয়ে, আনসার সদস্যদের দিয়ে সচিবালয় দখল করে, রিক্সা শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক, লাখটাকা ঋণের প্রলোভনে হাজার হাজার মানুষকে ঢাকায় এনে, ইসকন, হিন্দু মহাজোটসহ বিভিন্ন গোষ্ঠি ও সেক্টরের লোকদের সংঘটিত করে প্রতিবিপ্লবের নানামুখী অপতৎপরতা ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতারা সরাসরি বাংলাদেশবিরোধী উস্কানিমূলক ক্যাম্পেইনে লিপ্ত হয়েছেন। তারা যতই বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানকে জোরালো করছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন ততই জোরালো হচ্ছে। চিকিৎসা ও পর্যটনসহ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেয়া কিংবা আলু-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধের পর বাংলাদেশ তার বিকল্প ব্যবস্থা করে নিলে ভারতীয় সংশ্লিষ্টদের কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। কলকাতার পর্যটন, হাসপাতাল ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা পথে বসে যেতে বসেছে। কৃষকরা লোকসানের মুখে রাস্তায় পণ্য ফেলে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের বদলে পাকিস্তান-থাইল্যান্ডসহ অন্যদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া কমিয়ে স্বদেশ নির্ভর হচ্ছে। ভারতীয় চিকিৎসকরা এখন ঢাকায় আসার লাইন ধরেছে। ভারতের গরু রফতানি বন্ধের পর বাংলাদেশ গোসম্পদে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। আলু-পেয়াঁজের জন্যও ভারতের মুখাপেক্ষিতা আর থাকছে না। বাজার কারসাজি বন্ধ করতে পারলে এটা আরো অনেক আগেই সম্ভব ছিল। একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একপাক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এখন ভারতের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠেছে। দিল্লিতে তথাকথিত বাংলাদেশি অভিবাসিদের বিরুদ্ধে অভিযানের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত অবৈধ ভারতীয়দের গ্রেফতারের দাবি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। ভারত যখন বাংলাদেশকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করতে চাইছে, তখন দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। স্বৈরাচার উৎখাত করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অবারিত হওয়ায় বিখ্যাত বৃটিশ মেগাজিন ইকোনমিস্ট বাংলাদেশকে ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ স্বীকৃতি দিয়েছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নতুন বছরে বাংলাদেশ সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য, উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক নবযাত্রায় শামিল হবে। সে অগ্রযাত্রায় যারাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাইবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
সংবিধান সংশোধন-পুনর্লিখন প্রসঙ্গে
বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন
পিলখানা ট্রাজেডির বিচারে আশার আলো
বই আত্মার মহৌষধ
আরও

আরও পড়ুন

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা

গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা

বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই

বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই

দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ

দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ

সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই  শ্রমিকের মৃত্যু

সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই শ্রমিকের মৃত্যু

নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন

নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন

৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু

৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের

কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে  হাতেম

কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে হাতেম

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

প্রশ্ন: কিসব কারণে বিয়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়?

প্রশ্ন: কিসব কারণে বিয়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়?

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)

আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)

আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)

ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সভ্যতার জাগরণে আবুল হাসান আলী নদভির শিক্ষাচিন্তা

ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সভ্যতার জাগরণে আবুল হাসান আলী নদভির শিক্ষাচিন্তা